দায়িত্ব পালনে অতন্দ্র, নীতিবাগীশ হ্যাকার সন্দীপ
হ্যাকিংয়ের নাড়ি নক্ষত্র তাঁর চেনা। হামেশা এর তার কম্পিউটার নেটওয়ার্কে অবাধ যাতায়াত, কর্মসূত্রে অথবা সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে। তিনি হ্যাকার ঠিকই, তবে অপরাধী নন, সন্দীপ সেন গুপ্ত আসলে অনুমোদিত এথিক্যাল বা নৈতিক হ্যাকার। কারও কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই তাঁর লক্ষ্য।

সম্প্রতি এথিক্যাল হ্যাকাররা ভারতে খুব দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে। ইন্ডিয়ান কম্পিউটার এমার্জেন্সি রেসপন্স টিম এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতে গতবছর নভেম্বরে আটশরও বেশি ".in" ওয়েবসাইট এবং প্রায় সাতশ ".com" ওয়েবসাইট হ্যাকারদের হানার কবলে পড়েছে। এমনকি অত গোপনীয়তায় রাখা সরকারি কিছু ফাইলপত্রও প্রতিবছর সাইবার ক্রিমিনালরা হ্যাক করে নেয়। এই প্রবণতাই পেশাদার এথিক্যাল বা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের চাহিদা ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স ফার্মের ভবিষ্যৎবাণী, ২০১২র মধ্যে ১ লক্ষ ৮৮ হাজার এথিক্যাল হ্যাকারের প্রয়োজন পড়বে। সাইবার সিকিউরিটি এবং অ্যান্টি হ্যাকিং অর্গানাজেশনের তথ্য অনুয়ায়ী, ভারতে এই মুহূর্তে ২২ হাজার সাইবার সিকিউরিটি রয়েছেন। ন্যাসকমের অন্য একটি সমীক্ষা বলছে আগামী পাঁচ বছরে ভারতে ৫ লক্ষ এথিক্যাল হ্যাকার দরকার। সেখানে আমাদের আছে মাত্র ৪০ হাজার।
যাইহোক, ভারত এবং ভারতের বাইরে গত ১৬ বছরের বেশি সময় ধরে তথ্য প্রযুক্তির নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছেন সন্দীপ সেনগুপ্ত। সাধারণ মানুষের মধ্যে আইটি নিরাপত্তা নিয়ে সচেতনতা তৈরি করছেন। ২০০৫ সালে আইটি সিকিওরিটি ফোরাম হ্যাকারস লাইব্রেরি গঠন করেন। ৮০,০০০ সদস্য সংখ্যা নিয়ে সেই সময়ে হ্যাকারস লাইব্রেরিই সবচেয়ে বড় হ্যাকারস ফোরাম ছিল। ইনফোকমে সবচেয়ে বড় হ্যকিং কম্পিটিশনের আয়োজন করেছিলেন সন্দীপ। প্রায় দু হাজার এথিক্যাল হ্যাকার অংশ নিয়েছিলেন। হ্যাকিং কম্পিটিশন আদতে মেধা চিহ্নিত করার মঞ্চে পরিনত হয়েছিল।
২০০৪ সালে ‘আইসলিউশন’ সফটওয়ার সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেন। সফওয়ার ডেভেলপমেন্ট, কনসালটেন্সি এবং আউটসোর্সিং করে এই সংস্থা। ২০০৯ সালে সিঙ্গাপুরের সংস্থার একটি অফিস খোলেন সন্দীপ। ইন্ডিয়ান স্কুল অব এথিক্যাল হ্যাকিং ISOEH নামে একটি সংস্থায় যুক্ত ২০১১ সাল থেকে। এর সহ প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ISOEH মূলত গবেষণা করে, পরীক্ষা নিরীক্ষায় জোর দেয়, সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কর্পোরেট ট্রেনিং দেয়। ইনফরমেশন এবং সাইবার সিকিউরিটির গুরুত্ব বোঝাতে নিয়মিত প্রচারও করে ISOEH। একই সঙ্গে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে (যেমন-ডব্লিউবিইউটি, আইআইটি খড়গপুর, ভিআইটি এবং আরও অনেক) কর্মশালা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। সরকারি অফিস যেমন, সেন্ট্রাল এক্সাইজ, সিআরপিএফ, লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টার এবং কর্পোরেট সংস্থা সিইএসই, এবিপি এমন নানা জায়গায় ট্রেনিং দেয় সন্দীপের সংস্থা। ‘আইসলিউশন’ এর অংশ হিসেবে ISOEH ন্যাসকম, ডাটাসিকিউরিটি কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এবং সিআইআই-এর সদস্য সহকারি।

কলকাতার এথিক্যাল হ্যাকার সন্দীপ যে দক্ষতায় সবার কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ঢুকে হ্যাকারদের শায়েস্তা করেন, ঠিক একই তৎপরতায় রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরেও তথ্য প্রযুক্তিতে নিরাপত্তার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। ক্যরিয়ারের এই পর্যন্ত সন্দীপ সেনগুপ্ত এবিপি, সিইএসইর মতো বিভিন্ন সংস্থাকে তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নিরাপত্তার সুলুক দিয়েছেন। সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালের ওয়েবসাইটটি হ্যাকারদের কবলে পড়ে। সেখানেও ডাক পড়ে এথিক্যাল হ্যাকার সন্দীপের। সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল স্কুলগুলি। মর্ডান হাই স্কুল ফর গার্লস এবং সাউথ পয়েন্টের মতো স্কুলগুলিতে সন্দীপ নিখরচায় শিখিয়েছেন কীভাবে তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে হ্যাকরদের হাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা যায়। অন্যদিকে লালবাজারের সাইবার সেলে তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মশালায় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। সিআইআই আইসিটি ইস্ট (২০১৪, ২০১৫), এফআইসিসিআই (২০১৪) এবং ন্যাসকমে চেম্বার ছিল সন্দীপ সেনগুপ্তের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সেমিনার করছেন। পড়ুয়াদের আইটি সুরক্ষা নিয়ে পড়িয়েছেন। ন্যাসকমের তথ্য মেনে আইটি সুরক্ষা কর্মীদের যে অভাব রয়েছে তা পূরণ করতে ছাত্রছাত্রীদের এই ক্ষেত্রে কাজ করার উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিএসআই-ওএনজিসি, এয়ারটেল, কেপিএমজি, একসেনচান, কেপজেমিনির মতো বেশ কয়েকটি সংস্থায় অডিটও করছেন সন্দীপ সেনগুপ্ত।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লিখছেন সন্দীপ। লিখছেন সাইবার সিকিওরিটি নিয়ে। অংশ নিচ্ছেন টিভি শো-তে। আর এই সবকিছুর লক্ষ্য একটাই। সাইবার ক্রাইমের হাত থেকে দেশ এবং রাজ্যের তথ্য প্রযুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা।